04-December,2022 - Sunday
Past Project 1
ত্রিযামা
অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
====================
শেষ বিকেলের এক ফালি ম্লান সূর্যের আলো এসে নবনীতার শাড়িতে পড়েছিল। অক্টোবরের শুরুতে এমনই হয়। গেটের সামনে ধুলোমাখা দেবদারু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সে একবার নবনীতাকে স্পর্শ করে যায়!
নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে এই সময়টাতে তিনি বারান্দায় এসে বসেন। বাড়ির পাশেই বড় রাস্তা। হেঁটে যাওয়া মানুষের টুকরো টুকরো কথা, সাইকেল রিক্সার ভেঁপু, বাস-মিনিবাসের আর্তনাদ। সব মিলিয়ে নবনীতার মনে হয় তিনি বেঁচে আছেন। অন্তত তার নৈঃশব্দে ভরা জীবনটাতে এই শব্দ ঝঙ্কারেরর ভূমিকা অসীম।
তারপর সূর্য ডুবে গেলে নবনীতা উঠে পড়েন। ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালান। আর তুলসীমঞ্চের পাশে রাখা বংশদন্ডে একটা আকাশদীপ ঝুলিয়ে দেন।
কাকে পথ দেখাতে এই আকাশদীপ ? এ প্রশ্ন বার বার উঠেছে। তিনি জবাব দেননি। ত্রিশ বছর সেই পরলোকবাসী স্বামী প্রলয় না হারিয়ে যাওয়া অমলকে পথ দেখিয়ে আসছেন নবনীতা! একদিনের জন্যও ভুল হয়নি। পাড়ার লোকজন এই নিয়ে আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করেছে। এমন কী তাঁর মেয়ে শ্রীতমা কম অভিযোগ করেনি। কিন্তু নবনীতা অনড়।
সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেলেও নবনীতা নিজেকে বদলাতে পারেননি। চুন পলেস্তারা খসা এই জীর্ণ বাড়িটার থাম বড়গার সঙ্গে তার যেন একটা অলীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আশেপাশের ঝাঁ চকচকে আধুনিক বাড়িগুলোর পাশে তার এই জীর্ণ বাড়িটা নিতান্ত বেমানান ঠেকলেও তাকে প্রমোটারের হাতে তুলে দিতে পারেননি। তুলে দিতে পারলে হয়তো অনেক টাকা হাতে আসতো। কিন্তু এতদিনের মনের কোণে জমিয়ে রাখা প্রত্যাশাটা হারিয়ে যেতো। সেটা তিনি হারাতে চাননি।
প্রলয়ের সঙ্গে যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন তার বয়েস বড়জোর সতের আঠার। গাঁটছড়া বেঁধে প্রথমদিন এ বাড়িতে পা রেখেই বুঝেছিলেন প্রলয় ছাড়া। এই শূন্য বাড়িতে তার সঙ্গে কথা বলার মত তৃতীয় কোন প্রাণী নেই।
নবনীতার মন খারাপ হয়েছিল, এ কেমন ধারার বিয়েবাড়ি! বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা দুশো পাওয়ারের ম্লান লালচে আলোর একখানা বালব ছাড়া আর সব কিছুই সাধারণ। বরণ করার মানুষজন কোথায়? নবনীতার মনের কথা বোধহয় প্রলয় বুঝতে পেরেছিল। মুখে একটা শুকনো হাসি এনে বলেছিল, আমরা একটু আগে এসে গেছি। এখনই সবাই এসে পড়বে।
সবাই মানেতো বাইরের লোক। নিজেদের কেউ নেই? প্রশ্নটা করে নিজেরই খারাপ লেগেছিল নবনীতা।
প্রলয়ের প্রাণের বন্ধু অমল নবনীতার হাত ধরে বলেছিল, এতদিনের শূন্য বাড়ি এবার তোমার স্পর্শে পূর্ণ হবে বৌদি। নিজের সংসার তোমাকে নিজেই গুছিয়ে নিতে হবে।..........
শূন্য সংসার পূর্ণ হয়নি। জীর্ণ বাড়িটারও কোন মেরামতী হয়নি। নবনীতার মতোই যেন অতীতকে অবলম্বন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এরকম একটা জীবন কী নবনীতা চেয়েছিলেন। শ্রীতমা তখন পেটে এসেছে। কারখানার মাল কিনতে কলকাতায় গিয়ে আর ফিরলো না প্রলয়। যেন নিঃশব্দে নবনীতার জীবনে এসে নিঃশব্দে পালিয়ে যাওয়া ! প্রলয় ছাড়া এরকম নৃশংশ কাজ অন্য কেউ করতে পারতো?
কলকতা যাওয়ার দিন শঙ্কিত হয়ে নবনীতা বলেছিলেন, কলকাতা কিন্তু আমাদের মফঃস্বল- শহর নয়। শুনেছি অনেক বড় জায়গাঃ হাজার মানুষের
ভিড়, গাড়ি ঘোড়ার মিছিল।
শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল প্রলয়ের বন্ধু অমল। -কি যে বল বৌদি, আমরা কী বাচ্চা ছেলে যে হারিয়ে যাবো। দু'দিনের তো ব্যাপার। কাজ শেষ হ'লে সময়মতো ঠিক তোমার প্রলয়কে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
অমল বলেছিল বটে, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকে মৃত প্রলয়ের প্রাণহীন ঠাণ্ডা দেহটা একটা কফিনে পুরে বয়ে এসেছিল মাত্র। স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন নবনীতা। ঘটনার আকস্মিকতায় তার চোখের জল পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছিল। বাপের বাড়ির দিকে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। শ্বশুরবাড়িও জনশূন্য।
শব বহনের গাড়িটা যখন তাদের হেলে পড়া গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভেতরে প্রলয়ের হিমশীতল দেহটা শক্ত হয়ে আছে। লজ্জায়, অনুশোচনায় সেই মুহুর্তে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল অমল।
হ্যাঁ, একথা ঠিক। প্রলয়ের মৃত্যুর দায় তার নয়। তবুও একটা অপরাধবোধ অমলকে কুঁড়ে খাচ্ছিল। কলকাতা যাওয়ার দিন সকালে প্রলয় যখন তার বাঁ দিকের বুকে ব্যথার কথা বলেছিল, অমল তখন তাকে কোন গুরুত্ব দেয়নি। গ্যাস অম্বল বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। সেদিন প্রলয়কে সঙ্গে নিয়ে না গেলে হয়তো সে মরতো না।
নবনীতার মুখের দিকে এখন তাকাতে পারছে না অমল। গনগনে অনুতাপের আগুনে বুক পুড়ে যাচ্ছে। কষ্ট সরে গিয়ে- নবনীতার বেঁচে থাকার ভাবনাটা জেগে উঠছে। কী হবে মেয়েটার ? আর তার শরীরে যে জীবনটা একটু একটু করে হাত পা মেলে বড় হচ্ছে, তাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে নবনীতা? প্রলয়ের আকস্মিক মৃত্যু যন্ত্রণার চাইতেও যেন বড় হয়ে উঠেছিল এই ভাবনার যন্ত্রণা!
পাড়াপ্রতিবেশীরা সহানুভূতি দেখিয়েছিল, আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনে কেউ এগিয়ে এলো না। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে একা হয়ে গেলেন নবনীতা। বাঙ্গালি ঘরের একলা যুবতি বিধবা হলে যা হয় নবনীতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। উপকারের অছিলায় গা স্পর্শ করে কথা বলতে চেয়েছিল অনেকেই। রাতে পাহারা দেবার প্রস্তাব দিতেও কুণ্ঠিত হননি কিছু মানুষ। ভয়ে, আতঙ্কে শিউরে উঠলেও নবনীতা ভেঙ্গে পড়েননি। তার বার বার মনে হয়েছে, এ চরিত্রগুলো তার চেনা। অসহায় মেয়ে দেখলে যাদের নোলা ঝরে। আসল সত্যি তো সে নিজে। গর্ভে বেড়ে ওঠা জীবনটাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে এদের পাশ কাটিয়েই তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে।
ভেবেছিলেন বটে, কিন্তু কিছুদিন থাকার পর বুঝতে পেরেছিলেন তা হবার নয়। নিজের সীমিত ক্ষমতা আর মনোবল সম্বল করে বেশী দূর এগোন যায় না। প্রলয়ের কারখানা থেকে পাওয়া সাহায্যের কটা টাকা শেষ হয়ে গেলেই তাকে অনিবার্যভাবেই একদিন থেমে যেতে হবে।
এই বেঁচে থাকা না থাকার টানাপোড়ানে ক্ষত-বিক্ষত নবনীতা যখন দিশেহারা, তখন সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, চুন পলস্তরা খসা জীর্ণ বাড়িটার হেলে পড়া গেটে দাঁড়িয়ে অমল বলেছিলো, বৌদি দরজা খোল আমি অমল।
নবনীতা দরজা খুলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
প্রলয়ের মৃত্যুটা যেন আর একটা মানুষের বয়েস বাড়িয়ে দিয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, গালভরা দাড়ি, চোখের কোণে কালি ! -এ কী চেহারা করেছে। অমলদা? ম্লান হেসেছিল অমল। নবনীতার সিঁদুরবিহীন সিঁথিটা যেন তাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রলয়কে সে ফিরিয়ে আনতে পারেনি! ওর মৃত্যুর জন্য সে আংশিক দায়ী। - কি হলো? এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। নবনীতার কথায় সম্বিত হয়েছিল অমলের। সসঙ্কোচে ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতেই অবক্ষয়টা চোখে পড়েছিল। কেমন আছো বৌদি? প্রশ্নের উত্তরটা পাশ কাটিয়ে নবনীতা বলেছিলেন, চা খাবে অমলদা? প্রলয় চলে যাওয়ার পরে এ বাড়ির উনুনে আজ অবধি চায়ের কেটলি বসেনি। কথাটা শুনেও যেন শুনল না অমল। নবনীতার ভেঙ্গে পড়া সংসারের হাল দেখে মৃদুস্বরে বলেছিল, নস্ট্যালজিয়ায় ভুগে লাভ নেই বৌদি। সংসারের সব কিছুতেই সীমাবদ্ধতা আছে। যে চলে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু যাকে তোমার মধ্যে রেখে গেল- তার দিকে তাকিয়েই এখন পথ চলতে হবে। অমলের কথায় উদাস হয়েছিলেন নবনীতা। - সহায় সম্বলহীন একজন বিধবার জীবন টেনে নেওয়া অত সহজ নয় অমলদা। -সহায় সম্বলহীন! কথাটা শুনে বুকটা পুড়ে যাচ্ছিল অমলের। নবনীতার মাথায় নিজের হাতখানা রাখতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছিল। - আমি যাই বৌদি। আবার আসবো, গেটের কাছাকাছি এসে আবার ফিরে দাঁড়িয়েছিল অমল।
আমি সংসার করিনি। তার মারপ্যাঁচ ও জানিনা। শুধু এইটুকু বুঝেছি, যাকে হারিয়ে আজ ভাবছো আগামীকাল কীভাবে চলবে, পরবর্তী জীবনে দেখবে সে যে একদিন সবার সঙ্গে ছিল, সেই সত্যিটাই তুমি ভুলে গেছ। সংসারের এটাই নিয়ম। নাহলে মানুষ শোকে তাপে ধ্বংস হয়ে যেতো। নবনীতা কাঁদবেন না ভেবে রাখলেও চোখে জল এসেছিল। -- তোমরা পুরুষমানুষ অমলদা ঠিক বুঝবে না। একাকী চলার পথে মেয়েদের সব চাইতে বেশী ভয় তাদের শরীর নিয়ে। আর্তনাদ করে উঠেছিল অমল। -একাকী কেন বলছো বৌদি? প্রলয় চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কী আমাদের এতদিনের বন্ধুত্বটাও চলে গেছে। আমি কী তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনা? চমকে উঠেছিলেন নবনীতা। নিরাপত্তাহীন জীবনে এই বেঁচে থাকার আশ্বাসটা যে নতুন একটা যে আলোর সন্ধান দিয়েছিল। ..
তারপর এক এক করে দিন, মাস, বছর গেছে। শ্রীতমা পৃথিবীতে এসেছে। সার্মথ্যের অতিরিক্ত খরচ করে অমল তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। বর্তমানে শ্রীতমা কোলকাতার একটি সফটওয়্যার কম্পানিতে উঁচু পোস্টে চাকরি করছে। সল্টলেকে একখানি মাঝারি ফ্ল্যাটও কিনেছে। সব ঠিক আছে। কিন্তু যে কথাটা বলব বলব করে অমল আঠাশ বছর অপেক্ষা করেছিল সেটা আর নবনীতাকে বলা হয়ে ওঠেনি। একটা নীরব অভিব্যক্তির মধ্য দিয়েই সে যেন নবনীতার সমস্ত দায়-দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
নবনীতা প্রথম প্রথম অনুযোগ, অভিযোগ, মান অভিমান কম করেননি। কিন্তু অমল শোনেনি। শেষ অবধি দুরছাই বলে হাল ছেড়ে সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তাদের অস্তিত্বটাকে মহাশূন্যে মিলিয়ে দিয়েছিল শ্রীতমা।
শুরুতে যে মানুষটাকে একটা আবেগপ্রবণ দুর্বল মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। একদিন সন্ধেবেলায় আবছা অন্ধকারে তাকেই একটা ভয়ংকর প্রশ্ন করে বসলো সে।
নবনীতা তখন ঘরে ছিলেন না। অমলও বেরোবে বেরোবে করছিল, এমন সময় শ্রীতমা এসেছিল। -- তোমাকে একটা কথা বলি কাকু, যে কথা এই মুহুর্তে মাকে বলার কোন প্রয়োজন নেই। দেওয়ালে ঝোলানো বাবার ছবিটাকে আমি প্রতিনিয়তই দেখি। একজন আঠাশ-ঊনত্রিশ বছরের সুদর্শন যুবক ছাড়া সে ছবিটাতে কিন্তু আজ অবধি আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাইনি। হয়তো সেটা আমার দেখার ভুল, কিংবা এমনও হতে পারে মার চোখ দিয়ে আমি ছবিটাকে দেখছি না। বাবা বলে যাকে আমি ভেবেছি। ভাবতে ভাল লেগেছে। সে কেন আমার বাবা হতে পারছে না? কিসের দায়বদ্ধতায় সে নিষ্প্রভ, এত উদাসীন? আজ আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমি না জন্মালে না হয়তো আবার সংসারী হতে পারতো!
অবাক হয়ে শ্রীতমাকে দেখেছিল অমল। মেয়েটা যে বড় হয়ে গেছে চাকরি করছে। শুভেন্দু নামে তারই সহকর্মী এক যুবককে আগামী বছর বিয়ে করবে- এই ভাবনাগুলোই এতদিন মাথায় আসেনি।
কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? আঠাশ বছর যে সম্বোধনটা ভাব বাচ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে কী দেখতে চায় মেয়েটা?
কাছে এসে শ্রীতমার কাঁধে হাত রেখেছিল অমল। -পৃথিবীতে এই কেনর কোন উত্তর নেই। যেটাকে এখন তুই কি স্বাভাবিক বলে ভাবছিস। একটা সময় সেটাই তোর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকবে। এই নিয়ে বেশী গভীরে গেলে দুঃখটা শুধু তোর মধ্যেই থাকবে না। আরও ব্যাপক হয়ে সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। তার চাইতে ভাব না কেন, কোনদিন কিছু ছিল না। কোনদিন কিছু হবেও না। ছবিটা তোর বাবার। বাবারই থাকবে।-
আর বলতে পারেনি অমল। গলাটা ধরে এসেছিল। প্রলয়ের মৃত্যুর এত বছর পরে আবারো যেন প্রলয়ের জন্য কান্না পেল অমলের। -
সেদিন রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। সঙ্গে উথাল পাথাল হাওয়া। মনস্থির করেই নবনীতার কাছে এসেছিল। খানিক ইতস্তুত করে অমল বলেছিল, শ্রীতমা বড় হয়েছে। এই পৃথিবীর ভালো মন্দ, প্রেম ভালোবাসা বুঝতে শিখেছে। এবার বোধহয় এই বাইরের মানুষটায় সরে যাওয়াই উচিত।
মাথা নীচু করে নবনীতা বলেছিলেন, শুধুই বাইরের মানুষ। এ বাড়িতে তোমার অন্য কোন পরিচয় নেই ?
ভারী গলায় অমল বলেছিল, জোর করে পরিচয়ের গভীরতা দেখিয়ে এখন কি লাভ হবে! আঠাশ বছর সাহস করে যে কথাগুলো আমরা বলতে পারিনি, জীবন সায়াহ্নে তা প্রকাশ করে শুধু নিজেদেরই নয়, সমাজের চোখে শ্রীতমাকেও ছোট করে দেবে।
সে কী তোমাকে কিছু বলেছে ? মনে রেখো, শ্রীতমার কথাটাই এ বাড়ির শেষ কথা নয়। নবনীতার কথা শেষ হতে অমলের মনে হয়েছিল, সে যদি বলতে পারতো শ্রীতমা যা বলেছে, সেই অতি বাস্তব সত্যি কথাটাকে সামাজিক বিধিনিষেধের ভয়ে কিংবা মেয়ের ওপর দায়বদ্ধতার অজুহাতে আমরা দু'জনে এড়িয়ে থেকেছি। তাহলে নবনীতা কেঁপে উঠবেন। মানসিক পীড়ণে ক্ষতবিক্ষত হবেন। থাক না এসব। আর তাছাড়া লাভ লোকসানের অঙ্ক কষে এখন কী হবে! এত সংশয় এত দ্বিধাই বা হচ্ছে কেন? শ্রীতমা তো বলেই দিয়েছে, যে তোমরা শুধু নিজেদের বঞ্চিত করনি পিতৃস্নেহ থেকে আমাকেও বঞ্চিত করেছিলে।-
-সেদিনের সেই রাত শেষ হয়েছিল। ভোরের আলোয় গাছে গাছে পাখি ডেকেছিল, কিন্তু অমলের সেই স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠস্বর, " কইরে শ্রীতমা আমার চা টা" - দে শোনা গেল না, রাতের অন্ধকারে অকৃতদার বৃদ্ধ মানুষটা কীভাবে যেন হারিয়ে গেল!-
সন্ধে হয়ে গেছে। সামনের ফ্ল্যাট বাড়ির গেটের হ্যালোজেনটা জ্বলে উঠেছে। নবনীতা উঠে দাঁড়ালেন। আমলকে তিনি ভালো বেসেছিলেন, এ কথা সবার সামনে বলতে আজ আর কোন পিছুটান নেই, যেন এক ঐশ্বরিক ভালোবাসাকে প্রাণ ভরে উপভোগ করে তিনি পূর্ণ।
এখন তাকে ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে হবে। আর রোজের মতো ঝুলিয়ে দিতে হবে আকাশদীপ, যদি কোনদিন পথ চিনে অমল ফিরে আসে!