অন্তহীন ভ্রমণ
বাবলি সূত্রধর সাহা
" Life is a journey, not a destination "" ( Ralph Waldo Enerson).
ছোঁয়া
না ছোঁয়ার মধ্যে যে স্পেশটা থাকে ঠিক সেখানেই জীবন যেন বেঁচে থাকে। কত
ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে গিয়েও ধরে ফেলি খড়কুটো।যাকে আশ্রয় করে ফের সাজিয়ে
তুলি কবিতার সংসার বা সংসারের গার্হস্থ্য। গভীর বিষাদে যখন অবসাদগ্রস্ত হয়ে
পড়ি তখন সম্মোহিতের মতো বসে পড়ি কলম নিয়ে। জীবনের ভ্রমণ সিরিজে কত না
পরিস্থিতির টানাপোড়েন। বিভাজিত হতে না পারার যন্ত্রণায় যখন লুকিয়ে কাঁদি
তখনও ঈশ্বর যেন বলে ওঠেন ' আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে "।
আবার পথ চলা, আবার যাওয়া আসা। এযেন বেদুইন যাপনের জ্বলজ্বলে প্রতিফলন।
হেমন্তের
ভোর কুয়াশার আড়ালে কচুরিপানার ফুল থেকে একটা ধোঁয়াশার বৃত্ত তৈরি
হয়।বেগুনি ফুলগুলো জলে ভাসে আর বলে তোমরাও এমনই ভেসে থাক জীবনের মজা
পুকুরে। ওই মজা পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে নিউ আলিপুরদুয়ারের ব্রডগেজ লাইন।
আর তার পাশেই ঢালু মাঠ। ওখানেই বছরে দুবার তাঁবু খাটিয়ে বসত গড়ে তোলে
বেদুইন বা বাঞ্জারা।প্রায় গোটা ত্রিশ তাঁবু।পুরুষ মহিলা, শিশু বৃদ্ধ সকলেই
থাকে ওখানে৷ পরিবার পরিকল্পনা ওদের কাছে অকল্পনীয়। প্রতিটি তাঁবুতে কম
করেও চার পাঁচটি শিশু। গায়ে জামা নেই, চুলে জট, হাড় কঙ্কালসার শরীর। গরমে
যদিও কেটে যায় দিন। কিন্তু শীতে কি ভয়ংকর কষ্টে দিন যাপন করতে হয় তা বর্ণনা
করা যায়না।
সকাল হতেই পুরুষেরা নানা কাজে বের হয়ে
যায়। বিভিন্ন জড়িবুটি, শিকড় বাকড় বিক্রি অথবা মাছ ধরা ওদের পেশা। আর মেয়েরা
কোলে বাচ্চা নিয়ে দুপুরের দিকে বিভিন্ন বাড়ির বাগানে ঢুকে শুকনো ডাল,
পাতা, পড়ে থাকা গাছ কেটে নিয়ে জ্বালানি যোগায়। কেউ বকা ঝকা করে, কেউ তাড়িয়ে
দেয়। আবার অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে। সবচেয়ে মুশকিল হয় বয়স্কদের। কোন
কাজে তারা লাগেনা৷ ফলে খাবারের ভাগও কম। আবার কোনদিন জোটেনা। এভাবেই
ধীরেধীরে একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্টেশন যেতে আসতে কৌতূহল ভরে দেখি আর
ভাবি এরা ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে! মাস তিন চার থেকে আবার অন্যখানে চলে
যায়। এটাই কি এদের যাপন! ভবিতব্য! আমাদের মতো ওদের কোন ভোটার কার্ড,রেশন
কার্ড নেই কেন? ওরা তো অন্য গ্রহের প্রাণী হয়। ওদের নিয়ে ভাবার কেউ নেই!
পৃথিবীতে সব মানুষই নাকি অমৃতের সন্তান। পরিপূর্ণ মানুষের আকৃতি নিয়েই তো
ওরা বেঁচে আছে। তবে যাযাবরেরা কেন অবহেলিত। ছোটো ছোট শিশুদের মুখগুলো দেখলে
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। যেখানে কত অনুষ্ঠানে কত শীতবস্ত্র, খাবার বিলি হয়
দুঃস্থদের জন্য। সেখানেও ওদের জায়গা নেই। ওরা বঞ্চিত হয়তো যাযাবর বলেই। কেউ
যদি স্থায়ীভাবে একজায়গায় না থাকে তাহলে তার কোন রেসিডেন্সিয়াল পরিচয়
থাকেনা। তাহলে ওদের জন্য যদি স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যাতে একজায়গায়
স্থায়ীভাবে থাকে।এটা নিয়ে ভাবা যায় হয়তো! কিংবা যায়না। আমার ভাবনা ভুল৷
জীবন
তো শুধু যাওয়া আসার পালা। মাঝে খণ্ড খণ্ড রঙ বেরঙের স্বপ্ন। যে স্বপ্নে
কথা বলা পুতুল থাকে। অদৃশ্য সুতোর টানে সেই পুতুল লিখে যায় শুধু স্ব
অন্বেষণের আত্মকথা। বেদুইনদের সাথে কোন আত্মিক সম্পর্ক নেই। কথাও বলিনি খুব
একটা। কিন্তু দেখেছি ওদের যাপন চিত্র। হেমন্তে যখন সবার ঘরে ধোঁয়া ওঠা
ভাতের গন্ধ বের হয় তখন ওরা পোকাধরা চাল গম সেদ্ধ খায়। আবার গ্রীষ্মের
কাঠফাটা রোদে আমরা ফ্যান বা এসির আরাম ভোগ করি ওরা তখন পুড়তে থাকে খাবারের
সন্ধানে। প্রায় উলঙ্গ বাচ্চাগুলো স্টেশন ফিরতি যাত্রীদের কাছে শীর্ণ হাত
পেতে পয়সা চায়। আর বলে ' দে না বাবু কুছ প্যায়সা, দো দিনসে কুছ নেহি খায়া
""। খুব কম লোকই দেয়৷ অমানবিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন এই দেশ। কত মহান আমরা
দেখ৷
জীবনের এই বৈচিত্র্যময় ভ্রমণে আমরাও কি যাযাবর
নই! কত জায়গায় বসত গড়ি। কত ঘাটে নোঙর ফেলি। আবার ভেসে চলি সুদূরে। চলতে
চলতে কত অজানা পরিচয়, কত মধুর সম্পর্কে জুড়ে যাই৷ এমনকি সেই সম্পর্কের চরম
বিচ্ছেদও হয়৷ যে বিচ্ছেদের ঘেরাটোপে লুকিয়ে থাকে বন্ধন। আর যেখানেই বন্ধন
সেখানেই প্রোথিত থাকে বেদুইন যাপনের হাতছানি। শেষ রাতের তরল আঁধারে যখন
নিজেকে পুনর্নির্মাণ করি কিংবা লিখতে বসি কোন এক নিঃস্ব মানুষের জীবন
বৃত্তান্ত তখন কি মনে হয়না আমিও এক ছিন্নমূল পিতার সন্তান। যিনি পৈত্রিক
ভিটেমাটি ছেড়ে স্বজন বন্ধু ছেড়ে জীবন ধারণের জন্য চলে এসেছিলেন সুদূর আসাম
থেকে এই উত্তরবাংলায়। চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে আমাদের বাঁচতে
শিখিয়েছিলেন মাথা উঁচু করে। যা আমার সারাজীবনের সম্পদ। তাই প্রতিক্ষণে মনে
হয় আসলে প্রতিটি মানুষের জীবনেই লুকিয়ে থাকে যাযাবর জীবনের প্রতিচ্ছবি।
জীবনের কোন গন্তব্য নেই। শুধুই বর্ণময় বা বর্ণহীন ভ্রমণ।